শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৯ অপরাহ্ন

বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের শোষণ বাড়ানোর উপায়

বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের শোষণ বাড়ানোর উপায়

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন দৃশ্যত না থাকাটাই ‘জিরো কার্বন’ নামে পরিচিত। যদিও বাস্তবে জিরো কার্বনের দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় পদ্ধতিতেই বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। ফলে প্রকৃতিতে সর্বত্রই কার্বনের বিচরণ দেখা যায়। রাসায়নিক উপাদানেও কার্বনের উপস্থিতি ব্যাপক। উদাহরণস্বরূপ কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন উভয় উপাদানে কার্বনের উপস্থিতি রয়েছে। অন্যদিকে ফসিল ফুয়েল, ফরেস্ট ফায়ার, অ্যানিমেলের রেস্পিরেসন ও উদ্ভিদের ডিগ্রেডেশনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কার্বন বায়ুমণ্ডলে যোগ হচ্ছে। প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক জাতীয় উপাদানও বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক জাতীয় নন্ বায়োডিগ্রেডেব্ল উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে। এ প্লাস্টিক জাতীয় উপাদানের মাধ্যমে মাটি, পানি ও বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, যা পরিবেশগতভাবে কার্বন দূষণ নামে পরিচিত।

যদিও বাংলাদেশ ২০০২ সালে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম প্লাস্টিকের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তবুও বর্তমানে বাংলাদেশে অসংখ্য প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বছরে একজন মানুষ প্রায় ৫ কেজি পর্যন্ত প্লাস্টিক জাতীয় উপাদান ব্যবহার করছে। যদিও জিডিপি ও কর্মসংস্থানে প্লাস্টিক জাতীয় উপাদানের যথেষ্ট অবদান রয়েছে; কিন্তু পরিবেশগত দিক দিয়ে প্লাস্টিকের পরিবর্তে বিকল্প চিন্তায় অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

সমগ্র বিশ্বের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চীনে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক জাতীয় উপাদান তৈরি হচ্ছে। অঙ্কের হিসাবে বছরে প্রায় ৬০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক জাতীয় উপাদান চীনে উৎপন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৮ মিলিয়ন টন, জার্মানিতে ১৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন ও ব্রাজিলে ১২ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হচ্ছে। পরিসংখ্যানগত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত প্লাস্টিক জাতীয় উপাদানই মাটি, পানি ও বায়ুতে কার্বনের পরিমাণ লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে যাচ্ছে।

কার্বন চক্রে দেখা যাচ্ছে, গাছ কর্তৃক সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে বায়ুমণ্ডলে গঠিত কার্বন ডাই-অক্সাইড দ্বারা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদিত হওয়ায় কার্বন শোষিত হচ্ছে। তবুও নির্গত কার্বনের প্রায় ৫০ শতাংশ বায়ুমণ্ডলে থেকে যায়। বাকি ৫০ শতাংশের প্রায় ২৫ শতাংশ স্থলসীমায় বিদ্যমান উদ্ভিদ ও ২৫ শতাংশ সমুদ্রের অণুজীব, উদ্ভিদ ও সেডিমেন্ট কর্তৃক শোষিত হচ্ছে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, শীতপ্রধান অঞ্চলে কার্বনের শোষণ উষ্ণপ্রধান অঞ্চলের তুলনায় বেশি। সেই হিসাবে পোলার অঞ্চলে কার্বনের শোষণ অনেক বেশি। আশা করা হচ্ছে, একুশ শতকে সমুদ্র কর্তৃক বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের শোষণ বেড়ে যাবে। মোটা দাগে গাছ কর্তৃক বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড আকারে শোষিত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, কোন ধরনের গাছ দ্বারা কার্বন বেশি শোষিত হচ্ছে?

কম বয়স্ক একটি গাছ বছরে প্রায় ৫ হাজার ৯০০ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। অন্যদিকে ১০ বছরের বেশি পুরনো গাছ বছরে ২২ হাজার গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে ৬ হাজার ৯১৮ মাইল বিমানের ফ্লাইটে প্রায় ১ দশমিক ৮ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়। ওই পরিমাণ কার্বন শোষণের জন্য প্রায় শূন্য দশমিক ৭২ একর বনভূমি দরকার। যা হোক, জনসংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশের একজন মানুষ প্রায় ৬৬০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গমন করে যাচ্ছে। অপরদিকে ইউরোপিয়ান একজন নাগরিক প্রায় ১ হাজার ২০০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গমন করে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে ওই ১ হাজার ২০০ কেজি কার্বন মোকাবিলার জন্য প্রায় ৪ দশমিক ৮ একর কার্বন ফুট প্রিন্ট দরকার। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য প্রায় ১ দশমিক ৮৮ একর কার্বন ফুট প্রিন্ট দরকার; কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য প্রায় শূন্য দশমিক ২৩ একরের কার্বন ফুট প্রিন্ট রয়েছে, যা স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের বিশাল অন্তরায়।

বিশ্বে ২০টি দেশ বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে। তার মধ্যে চীন প্রায় ১০ গিগাটন কার্বন নির্গমনে শীর্ষে অবস্থান করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া ৫ দশমিক ৪১, ২ দশমিক ৬৫ ও ১ দশমিক ১ গিগাটন কার্বন নিঃসরণে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হলো টুভালু। দেশটি সমুদ্রঘেরা হওয়ায় বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের পরিমাণ খুবই কম, যা পরিবেশ সংরক্ষণে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে সমগ্র বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। পরিসংখ্যানগত তথ্যে আরও দেখা যাচ্ছে, ভুটানও একটি কার্বন নেগেটিভ দেশ। ওই দেশটিতে কার্বন নেগেটিভ হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বনায়ন, যেখানে প্রায় ৭২ শতাংশ ভূমি বনায়ন দ্বারা আবৃত। সরকারি পর্যায়ে পানি দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রেখে জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। এলইডি লাইট ও বৈদ্যুতিক যানবাহনও বিনামূল্যে জনগণকে দেয়া হচ্ছে। ভুটান সরকার আশা করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটি বিশ্বে জিরো কার্বন নির্গমনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। সম্প্রতি বিশ্বের প্রায় ১১০টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে জিরো কার্বনের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, গাছ ও সমুদ্র কর্তৃক সবচেয়ে বেশি কার্বন শোষিত হচ্ছে। গাছের মধ্যে ওক, টিউলিপ, নাট, মালভেরি, ইউক্যালিপটাস ও পাইন জাতীয় গাছ বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ডেসিডুয়াস প্রজাতির গাছপালা বনায়নে দৃশ্যমান। ওইসব গাছপালার বায়োমাস কর্তৃক প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ কার্বন শোষিত হচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তার পাশে বড় আকৃতির পুরনো বয়স্ক গাছ কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে কার্বন ফুট প্রিন্ট অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। ওই কার্বন ফুট প্রিন্ট বাস্তবে বাড়ানো কতটা সম্ভব? বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন শোষণের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য যে কোনো দেশে মোট ভূমির কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৭ শতাংশ, যা বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন শোষণের জন্য খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া মানুষ পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব বিবেচনায় না নিয়ে অহরহ বড় বড় গাছ কেটে বনভূমি উজাড় করে যাচ্ছে।

যা হোক, একুশ শতকের শেষে গ্লোবাল তাপমাত্রা ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, যদি কার্বন নিঃসরণ কমানো না যায়, তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। এর ফলে সমগ্র বিশ্বে করোনার মতো অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী আশা প্রকাশ করে বলেছেন, গ্লোবাল তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি কোনোক্রমেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। সেজন্য বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন শোষণের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে।

মোটা দাগে দেখা যায়, অনবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন, গাছপালা নিধন, জলাভূমি ভরাট, অপরিকল্পিত কলকারখানা স্থাপন ও নগরায়ণে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। কার্বনের নির্গমন কমানো যদিও একটি গ্লোবাল ইস্যু; তবুও আঞ্চলিকভাবে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের শোষণ কমানো প্রতিটি দেশের নৈতিক দায়িত্ব। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের শোষণ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। প্রথমত, বিদ্যমান বনায়নের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর দিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক বনায়নে নতুন নতুন গাছপালা রোপণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের শোষণ বাড়ানো যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সমুদ্র কর্তৃক প্রচুর পরিমাণ কার্বন শোষিত হওয়ায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়ে সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের শোষণ বাড়ানো যেতে পারে। তৃতীয়ত, কয়লার পরিবর্তে বায়ু, পানি, সমুদ্রের ঢেউ ও বায়োগ্যাসের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্থত, জলাভূমির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে জলাভূমিতে বিদ্যমান গাছপালা ও সেডিমেন্টের মাধ্যমেও বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন শোষিত হতে পারে। পঞ্চমত, কলকারখানা কর্তৃক কার্বন নিউট্রাল করে বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ করতে হবে। ষষ্ঠত, যেহেতু প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য ডিগ্রেডেশনের মাধ্যমে বায়ু, পানি ও মাটিতে কার্বনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে, তাই প্লাস্টিকের পরিবর্তে বিকল্প জিনিস ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সপ্তমত, রাস্তার পাশে ১০ বছরের বেশি পুরনো গাছ কাটার ক্ষেত্রে আইনগত নিষেধাজ্ঞা থাকতে হবে।

যদিও বাংলাদেশের পক্ষে জিরো কার্বনের দেশে পরিণত হওয়া বেশ কাঠন; তবুও প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে কার্বন শোষণের ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। নতুবা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে বাংলাদেশের মতো বহু দেশের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বায়ুমণ্ডলে নির্গত নেট কার্বনের নেগেটিভ দৃশ্যায়নেই মাবনজাতির টেকসই জীবনযাপনে ভূমিকা রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877